Posted by: Dr. Salehuddin Ahmed, Former Governor of Bangladesh Bank
Date: 9th July 2014
বাংলাদেশের অগ্রগতির ক্ষেত্রে যে খাতগুলো বড় ভূমিকা রাখছে, তার মধ্যে ব্যাংকিং খাত অন্যতম। ব্যাংকিং খাতের বিশেষ দিকে হচ্ছে এটি মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে। ব্যাংকিং খাতে কোনো সমস্যা থাকলে এর প্রভাব শুধু সে খাতেই সীমাবদ্ধ থাকে না, তা অর্থনীতির অন্যান্য ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ে। এটা সংক্রামক ব্যাধির মতোই দ্রুত অন্যান্য খাতকেও আক্রমণ করে। এটা হচ্ছে ‘ফিন্যান্সিয়াল কন্টাজিয়ন’, যা সংক্রামক ব্যাধির মতো উৎপাদন খাত ও মানুষের জীবনযাত্রার ওপর প্রভাব ফেলে।
কিছু উদাহরণ জাজ্বল্যমান। ২০০৭ সালের বৈশ্বিক আর্থিক খাতের সংকটের সূত্রপাত হয় যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকিং খাত থেকে। তারপর সেটা দেশটির অন্যান্য খাত ও পরে অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ে। সাইপ্রাস, স্পেন, গ্রিস, ইতালি প্রভৃতি দেশ এখানো এ সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেনি। বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের কোনো নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের ওপর পড়েনি।
বছর কয়েক আগে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত সুশৃঙ্খলভাবেই চলছিল। ব্যাংকগুলোতে নিয়ম-নীতিমালা পরিপালন করা হচ্ছিল, সেগুলো একরকম নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিককালে বেশ কিছু অনভিপ্রেত ঘটনার কারণে খাতটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। তবে এ থেকে উত্তরণের সুযোগ রয়েছে। দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম অভিন্ন। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সরকার নিয়ন্ত্রণ করে, যেমন পরিচালনা পর্ষদ গঠন। পরিচালকদের নিয়োগ দেওয়া হয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনায়। এ ক্ষেত্রে যোগ্যতা-দক্ষতা সব সময় বিবেচনা করা হয় না। ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুযায়ী পদোন্নতি দেওয়া হয় না বলে অভিযোগ আছে। এসব কারণেই হল-মার্ক ও বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারির মতো ঘটনা ঘটতে পেরেছে। এসব ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ, ব্যবস্থাপনা, নজরদারি ও পরিবীক্ষণ—সব ক্ষেত্রেই ব্যর্থতা রয়েছে। অর্থাৎ পুরো ব্যবস্থায়ই ফাটল ধরেছে।
সম্প্রতি বেসিক ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকার অনিয়ম ধরা পড়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা সীমিত। এখানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ভূমিকাই মুখ্য।বাংলাদেশ ব্যাংকের যেসব নিয়ম রয়েছে, সেগুলো যথেষ্ট ভালো ও আন্তর্জাতিক মানের। আমাদের ব্যাংক কোম্পানি আইনেও বিধিবিধান রয়েছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, এসব নীতিমালা, বিধিবিধান সঠিকভাবে পরিপালন বা কমপ্লায়েন্স হচ্ছে না। এটি দেখভালের মূল দায়িত্ব ব্যাংকগুলোর। দ্বিতীয়ত, এসব নীতিমালা সঠিকভাবে পরিপালন হচ্ছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের।মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংক সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারছে না। তাদের পক্ষ থেকে সময়োচিত ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।এই সমস্যা দূরীকরণে বাংলাদেশ ব্যাংককে সচেষ্ট হতে হবে এবং দৃঢ়তা, সততা, দক্ষতা ও দ্রুততার সঙ্গে ব্যাংকটির ক্ষমতা যথাযথভাবে ব্যবহার করতে হবে।
মনে রাখতে হবে, ব্যাংকিং খাতে উদ্ভূত সমস্যা দ্রুত নিরসন করতে না পারলে দেশের প্রবৃদ্ধি থমকে যাবে, দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি মুখ থুবড়ে পড়বে। আর ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা কঠিন হয়ে পড়বে। অনেক দেশে আর্থিক খাতের অনিয়ম তদন্তের জন্য পৃথক সংস্থা থাকে। বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশন সে কাজটি করে থাকে। কিন্তু এটা করতে যে পরিমাণ লোকবল দরকার, তাদের সেটা নেই। একই সঙ্গে সংস্থাটির দক্ষতার অভাবও প্রতীয়মান, তদন্তের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা তো আছেই। সে কারণে বড় বড় আর্থিক দুর্নীতির তদন্তের জন্য আলাদা সংস্থা গঠনের বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। আর তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের বিচারের আওতায় আনাও জরুরি। ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের দৃশ্যমান ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। সেটা করতে হলে সরকারের সদিচ্ছা থাকতে হবে। ব্যাংকিং খাতে দক্ষ ও নিষ্ঠাবান মানুষদের নিয়োগ দিয়ে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।
ব্যাংকিং খাতে বিভিন্ন সময় সংস্কার হয়েছে ঠিকই, কিন্তু কখনোই এসবের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি। ব্যাংকিং খাতের সেবা নিয়েও গ্রাহকেরা অনেক অভিযোগ করছেন, চার্জও বেশি নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। এটা রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি উভয় ধরনের ব্যাংকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হলে আমাদের ব্যাংকগুলোর কার্যক্রমের গুণগত মান এবং সেবার মান উন্নত করতে হবে। শুধু শাখা বাড়িয়ে ও জমি কিনে এটা নিশ্চিত করা যাবে না। একই সঙ্গে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ ব্যয় ও অপচয় কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অন্য ব্যাংকগুলোকে সচেষ্ট হতে হবে।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত বড় ধরনের সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এটা মোকাবিলায় সরকারের ইতিবাচক পদক্ষেপ যেমন দরকার, তেমনি বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকেও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে সময়োচিত, যথাযথ ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে। এ খাতের বিরাজমান অব্যবস্থাপনার কারণে শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপরই প্রভাব পড়বে না, চূড়ান্তভাবে জনগণের ওপরই এর সবচেয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। জনগণের করের টাকায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণ হচ্ছে। দুর্নীতিবাজদের দায়ভার জনগণ নেবে কেন? মনে রাখতে হবে, ব্যাংকিং খাতের উন্নতি হলে দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়বে, টেকসই ও সুষম উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।